বাশোর পুকুর

মাৎসুও বাশো (১৬৪৪ – ১৬৯৪)

জাপানে টোকুগাওয়ার সময়কালের (১৬০৩ – ১৮৬৮) বিখ্যাত কবি, এবং আজো জাপানের একজন পাঠক-প্রিয় কবি। এখন সে আমাদের কাছে হাইকু (তখনো বলা হতো হোককু) কবিতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসাবেই পরিচিত। তার অতি বিখ্যাত হাইকু: একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ে পুরানো পুকুরে, পানির শব্দ।

ছোট্ট এই কবিতাটাকে বলা যায় জাপানী কবিতার আইকন। কবিতাটা বিভিন্ন ভাষায় বহুবার অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন কবি। ইংরেজি ভাষায় প্রায় ত্রিশ জনেরও বেশী কবি কবিতাটকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন। এল্যান গিন্সবার্গ এর ভিষন সুন্দর একটা অনুবাদ করেছেন: The old pond / A frog jumped in, / Kerplunk! (পুরাতন পুকুরটা / একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ে তাতে / ধপাস!) এখানে হাইকুর সনাতনী প্রথা ব্যবহার না করে আধুনিক ফ্রি ফর্ম ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রচলিত মতে, একবার বাশোর জেন -গুরু, বোনচো, বাশোর সাথে দেখা করতে এসে কথা প্রসঙ্গে তিনি বাশোকে একটা ধাঁধা ধরেন। বাশো তার উত্তর না খুঁজে বলেন “একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ে, পানির শব্দ হয়।“ আরেকটা প্রচলিত মতে বলা হয়েছে, এক ভোররাতে বাশো স্বপ্ন দেখেন যে তুমুল বৃষ্টির মধ্য সে আশ্রয় নিতে ঢোকে একটা জেন মন্দিরে। তখন সেখানকার জেন পুরহিত তাকে বলেন চলে যেতে নইলে তার প্রশ্নের জবাব দিতে। সে একটা ধাঁধা ধরে এবং বাশো তার কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন ব্যাঙের এই হাইকুটা।

মূল জাপানীতে হাইকুটা দেখে নিয়ে, বুঝে নিতে পারলে হাইকুর সনাতনী প্রথা একেবারে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

(কাঞ্জি)
古池や蛙飛こむ水のおと

(হিরাগানা)
ふるいけやかわずとびこむみずのおと

(রোমাজি) বা ইংরেজিতে জাপানী উচ্চারণ
Furuike ya kawazu tobikomu mizu no oto

(বাংলায় জাপানী উচ্চারণ)
ফুরুইকি ইয়া কাওয়াজু টোবিকোমু মিজু নো ও-টো

বাংলায় জাপানী শব্দের অর্থ
ফু-রু (পুরানো) ই কি (পুকুর) ইয়া, কা-ওয়া-জু (ব্যাঙ) টো-বি-কো-মু (লাফিয়ে পড়ে) মি-জু (পানি) নো ও-টো (শব্দ)

প্রথমেই জাপানী উচ্চারনে এই ছোট্ট কবিতাটাকে হাইকু (সে সময়ের হোককু) হিসেবে বিবেচনা করবার আগে এর চরণ সংখ্যা ও অক্ষর সংখ্যা গনণা করে নেওয়া যাক:
ফু / রু – ই / কি – ইয়া, চরণ ১: অক্ষর = ৫
কা / ওয়া / জু – টো / বি / কো / মু চরণ ২: অক্ষর = ৭
মি / জু – নো – ও / টো চরণ ৩: অক্ষর = ৫

অর্থাৎ এতে তিন চরণে ৫/৭/৫-বিন্যাসে মোট সতেরোটা অক্ষর পাওয়া গেলো।
এবার কবিতাটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রথম চরণে কবি অতি সাধারণ একটা ছবি তুলে ধরেছেন: ফুরু ইকি অর্থাৎ পুরানো পুকুর। জাপানী ভাষার ‘ইয়া‘ কিরেজি। বাংলা ভাষার লেখাতে এমন কোনো শব্দের ব্যবহার হয় না, ইংরেজিতেও এর ব্যবহার নেই। জিাপানী কিরেজি শব্দ বাংলার যতি ও অর্ধ-যতির মতো। ইংরেজিতেও তাই।

দ্বিতীয় চরণে পাই আরো একটা ছবি “একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ে“। এবং তৃতীয় চরণে দৃশ্যটার সাথে সাথে কবিতাটা সম্পন্ন হয় –কবির অনুধাবনে, “পানিতে শব্দ“।
অর্থাৎ এখানে ‘পুরানো পুকুর‘ আর ‘একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়া‘ ছবি দুটো সংযোগ করার কাজে ‘ইয়া‘ কিরেজি দিয়ে কিছুটা বিরাম সৃষ্টি করা হয়েছে।

দ্বিতীয় চরণে ব্যাঙ শব্দটা ব্যবহার করা হয়েছে। জাপানী সংস্কৃতিতে ব্যাঙ হলো একটা ছোট-খাটো সুখী প্রানোচ্ছল প্রাণী, বসন্তের ইঙ্গিত বহন করে ব্যাঙ। তাহলে কবিতাটাতে একটা কিগো পাওয়া গেলো।এবার দেখা যাক, জাপানী ভাষা থেকে কবিতাটা বাংলায় আক্ষরিক অনুবাদ করলে কী দাঁড়ায়:

পুরানো পুকুর,
একটা ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ে
পানিতে শব্দ হয়

বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় এই ছোট্ট কবিতাটার অনেক রকেমের অনুবাদ আছে। শুধু ইংরেজি ভাষাতেই ত্রিশটারও বেশী অনুবাদ পাওয়া যায়। বাংলাতে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এর একটা অনুবাদ করেছেন: পুরোনো ডোবা, – দাদুরি লাফালো যে, – জলেতে ধ্বনি।– ইংরেজিতে এর একটা সাদামাটা অনুবাদ পাওয়া যায় R.H.Blyth- এর: — The old pond: – a frog jumps in, – the sound of the water. —

এর সবগুলোই ভালো অনুবাদ, কোনো কোনোটা আবার খুব ভালো কবিতাও; হাইকু (সনাতনী ধারায় লেখা হাইকু) বা নয়া ধারায় লেখা আবার নিছকই ছোট কবিতা।
হাইকু একটা রকমের কবিতার ধারা অর্থাৎ হাইকু হতে হলে তা কবিতা হতেই হবে। যেমন কবি হতে হলে আগে মানুষ হতেই হবে। কেন না গাছকে নিয়ে অনেক কবিতা লেখা হলেও, গাছতো আর কবিতা লিখতে পারে না। কবিতা লেখে কবি। কয়েকটা সুন্দর সুন্দর শব্দ সাজিয়ে মহৎ কোনো বানী বলে দিলে বা অনুভূতি বলে ফেললেও সেটা কবিতা হবেই এমন কোনো কথা নেই। আমি এখানে অলঙ্কার শাস্ত্রের আলোকে বিচার বিশ্লেষনের জঠিল আলোচনা করছি না। বাক্যে কাব্যের প্রাণ লক্ষণের কথা বলছি।

প্রথমত: অন্ত্যমিল থাক বা না থাক ছন্দ তাতে থাকতেই হবে। অন্য কখনো ছন্দ নিয়ে বিশদ আলোচনায় বসা যাবে সুযোগ-সুবিধে মতো। এখন কবিতা হয়ে ওঠার লক্ষণগুলো, দ্বিতীয়ত: তার দৃশ্যতঃ অর্থের বাইরেও অন্তরে একটা অর্থ থাকতে হবে। মানে যেটুকু লেখা আছে শুধু ততটুকুই নয়, না-বলা অনেক কথাও ওর মধ্যে থাকতে হবে। আর প্রধান উপাদান কবির অনুধাবন; চিন্তন-দর্শন (চোখের ও মনের)-অনুভবের পশ্চাদ্ধাবন করে করে কবি যে নির্যাস বের করে নিয়ে সঞ্চয় করতে পারেন, সেই অনুধাবনের ছিটে ফোঁটা থাকতে হবে কবিতায়।

অর্থাৎ, হাইকুর মধ্যে –হাইকুর কাঠামোতে কবিতার এই গুণ গুলোও থাকতে হবে। তিনটে চরণ, ৫ / ৭ / ৫ ওঞ্জির বিন্যাসে একটা কিরেজি ও কিগো ব্যবহার করে লেখা হবে, তাতে অন্ত্যমিল থাকতে হবেই এমন কোনো বাঁধা ধরা নিয়ম নেই তবে ছন্দ থাকা জরুরী। তার অন্তরের গোপনে অর্থ থাকতে হবে, এ ক্ষেত্রে কিরেজি সে কাজ করছে। আর থাকতে হবে কবির অনুধাবন।

বাশোর পুরানো পুকুরে বাশোর অনুধাবনটাও বোঝা দরকার। এখানে একটা কথা বুঝে নেয়া দরকার। একই কবিতা ভিন্ন ভিন্ন পাঠকের কাছে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে প্রকাশ পায় কবির অনুধাবন প্রকাশ করা থাকে না বলেই। কবিতার কথায় বলা কথার বাইরে যে না-বলা কথা, তা বোঝা গেলেও কবির অনুধাবনের কথা শব্দের আনাছে কানাছে লুকিয়ে থাকে বলে ধরা কঠিন হয়ে ওঠে। ঠিক নারী যেমন, একেকজনের কাছে একেক চেহারা। তাইতো সে রমনী –শুধু রমন অর্থে নয়, সে ললনা, দুহিতা আরো কত কী।

হ্যা, পুরানো পুকুরে বাশোর অনুধাবন কী?

জাপানী, ফুরু ইকি ইয়া – কাওয়াজু টোবিকোমু – মিজু নো ও-টো; সব কিছুই মোটা মুটি ঠিক চলেছে বাঁধ সাধে এসে ‘ও-টো‘-তে।

মিজু মানে পানি, নো মানে এর, ওটো মানে শব্দ। জাপানী ‘ওটো‘ হলো ধ্বন্যাত্মক, অর্থাৎ শব্দের অনুকরণযুক্ত শব্দ ঠিক অনুরণন বা প্রতিধ্বনিও নয়। সাধারন ভাবে বলা যায় পশুর ডাকের মতো শব্দ; গর্জন, ম্যাও, ক-ক ক-ক এমন।

ইংরাজি অনুবাদকরা বেশীর ভাগই ‘ওটো‘র বদলে ব্যবহার করেছেন splash শব্দটা, মানে ঝপাৎ (পানিতে পড়ার শব্দ)। কেউ কেউ ব্যবহার করেছেন plop, প্লপ মানে ছোট-হালকা শক্ত কোনো বস্তু পানিতে ফেলে দিলে তেমন-পানি না ছিটিয়ে যে একটি ছোট শব্দ তোলে। কেউ লিখেছেন plash (ঝর ঝর করে পড়া) বা plunks (ঝুপ ঝুপ করে পড়া), কোনোটাই ‘ওটো‘ শব্দটার অনুভূতি দেয় না। এল্যান গিন্সবার্গ ব্যবহার করেছেন kerplunk শব্দটা। কার্প্লঙ্ক হলো ডাব মাটিতে পড়লে যে রকম একটা ভোতা ভোতা ধপ্পাস শব্দটা হয় সেটা।

কথা হলো ধান ভানতে শীবের গিত গাইছি কেনো? কারন কবির অনুধাবন ঐ শব্দটার বাছাইতে।

কবি যখন কবিতাটা / হাইকু (তখনকার হোককু) লিখছিলেন তখন তার চোখের সামনে দেখা কোনো পুকুরে একটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে পানিতে পড়েছে, তা নয়। কবি নিরব নিস্তব্দতার মধ্যে ঘরে বসে একটা শব্দ শুনতে পান। তখনই সে কল্পনায় দেখে নেয় যে, তারে আশে পাশের চেনা একটা পুকুরে কোনো একটা ব্যাঙ বেধ হয় লাফিয়ে পড়লো এই বসন্তকালে।

এই ধপ্পাস শব্দটাই তার অনুধাবন বা চিন্তন-দর্শন-অনুভবের পশ্চাদ্ধাবন করে করে কবি যে নির্যাস জমিয়েছেন, তাই। কবিতায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।